বিবর্তন বা অভিব্যক্তির ফলে নতুন প্রজাতির অথবা একটি প্রজাতি থেকে অন্য একটি প্রজাতির উৎপত্তি হয়। অভিব্যক্তির কৌশল সম্পর্কে যে সকল বিজ্ঞানী বিভিন্ন মতবাদ (theories) প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁদের মতবাদগুলো আমরা এখন আলোচনা করব ।
৪.৪.১ ল্যামার্কের তত্ত্ব
ল্যামার্ক (চিত্র ৪.২০) 'বায়োলজি' শব্দটির প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি প্রথম বিবর্তন বা অভিব্যক্তির ওপর বিশ্লেষণী তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এ বিষয়টি তিনি ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা 'ফিলোসোফিক জুওলজিক' (Philosophic Zoologique) নামে একটি বইতে লিপিবদ্ধ করেন।ল্যামার্কের তত্ত্বকে ল্যামার্কিজম (Lamarckism ) বা ল্যামার্কবাদ বলে। কয়েকটি প্রধান প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে ল্যামার্কবাদ পঠিত। সেগুলো এখানে আলোচনা করা হলো:
১. ব্যবহার ও অব্যবহারের সূত্র
ল্যামার্কের মতে, জীবের প্রয়োজনে জীবদেহে কোনো নতুন অঙ্গের উৎপত্তি অথবা কোনো পুরোনো অঙ্গের অবলুপ্তি ঘটতে পারে। তাঁর মতে, যদি কোনো জীবের কোনো অঙ্গ ধারাবাহিকভাবে ক্রমাগত ব্যবহৃত হয়, তবে সেই অঙ্গ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তার জন্য ধীরে ধীরে সবল ও সুগঠিত হবে। অন্যদিকে, জীবের কোনো অঙ্গ পরিবেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় হলে ঐ অঙ্গের আর ব্যবহার থাকে না। সুতরাং ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে অঙ্গটি নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হবে এবং অবশেষে অবলুপ্ত হয়ে যাবে। ল্যামার্কের মতে, অঙ্গের ব্যবহার ও অব্যবহার জীবদেহে পরিবর্তন সূচিত করে, যা জীবের বংশপরম্পরায় অর্জিত বৈশিষ্ট্য।
২. পরিবেশের প্রভাব
জীব সদা পরিবর্তনশীল পরিবেশে নিজেকে উপযুক্তভাবে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সব সময় চেষ্টা করে। এটি জীবের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তনশীল পরিবেশে নিজেকে অভিযোজিত করতে জীবদেহে নানা রকমের পরিবর্তন দেখা যায়। ল্যামার্কের মতে, পরিবেশের পরিবর্তন ঘটলে জীবের স্বভাব এবং দৈহিক পরিবর্তন ঘটে। এটাও একটি জীবের অর্জিত বৈশিষ্ট্য।
৩. অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ও নতুন প্রজাতির উৎপত্তি
ল্যামার্কের মতে, কোনো জীবের জীবনকালে যে সকল বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়, সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় অর্থাৎ অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ঘটে।ল্যামার্কের তত্ত্ব অনুযায়ী, অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের জন্য এবং প্রতিটি প্রজন্মে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জিত হওয়ায় ধীরে ধীরে একটি প্রজাতি থেকে অপর একটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।ল্যামার্ক কতগুলো পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই তার মতবাদ রচনা করেছিলেন। তার দেওয়া কয়েকটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে মতবাদটির স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়া হলো :
আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা জৈব বিবর্তনে ল্যামার্কের মতবাদ গ্রহণ করতে পারেননি। শুধু সময়ের সাথে প্রজাতির পরিবর্তন হয়েছে, সেটি বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন না। বংশগতিবিদ্যার প্রসারের পর বিজ্ঞানীরা জীবের মধ্যে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুক্রম অনুসন্ধান করেছেন কিন্তু সেটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ বাস্তব অর্জিত বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়, এর স্বপক্ষে বর্তমান বংশগতিবিদগণ কোনো প্রমাণ পাননি। সহজভাবে বলা যায়, কোনো মানুষ ব্যায়াম করে এবং ক্রমাগত ব্যবহার করে তার একটি হাতকে শক্তিশালী করে তুললে তার সন্তান শক্তিশালী হাত নিয়ে জন্ম নেবে সেটি সত্যি নয় ।
৪.৪.২ ডারউইনবাদ বা ডারউইনের মতবাদ
ল্যামার্ক বিবর্তনের যে মতবাদ দেন, তার ৫০ বছর পর ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (চিত্র ৪.২১) একটি বৈপ্লবিক চিন্তাধারার সৃষ্টি করেন। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (Charles Darwin, ১৮০১- ১৮৮২) ইংল্যান্ডের সাসবেরি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পরিভ্রমণকালে তিনি ঐ অঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য দেখে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন এবং সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তনের প্রায় ২০ বছর পরে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা প্রজাতির উদ্ভব' (Origin of species by means of natural selection) নামে একটি বইয়ে তাঁর মতবাদটি প্রকাশ করেন।
ডারউইনের দৃষ্টিতে প্রকৃতিতে সংঘটিত সাধারণ সত্যগুলো এরকম:
১. অত্যাধিক হারে বংশবৃদ্ধি
ডারউইনের মতে, অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি করাই জীবের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এর ফলে জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারে জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি সরিষা গাছ থেকে বছরে প্রায় ৭৩০,০০০টি বীজ জন্মায়। এই ৭৩০,০০০ বীজ থেকে ৭৩০,০০০ সরিষা গাছের জন্ম হওয়া সম্ভব। আবার একটি স্ত্রী স্যামন মাছ প্রজনন ঋতুতে প্রায় ৩ কোটি ডিম পাড়ে। ডারউইনের মতে, এক জোড়া হাতি থেকে উদ্ভূত সবগুলো হাতি বেঁচে থাকলে ৭৫০ বছরে হাতির সংখ্যা হবে এক কোটি নব্বই লাখ ।
২. সীমিত খাদ ও বাসস্থান
ভূপৃষ্ঠের আয়তন সীমাবদ্ধ হওয়ায় জীবের বাসস্থান এবং খাদ্য সীমিত।
৩. অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম'
জীবেরা জ্যামিতিক ও পাণিতিক হারে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় এবং খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় জীবকে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ডারউইন এ ধরনের সংগ্রামকে 'অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম' বলে অভিহিত করেন। ডারউইন লক্ষ করেন যে জীবকে তিনটি পর্যায়ে এই সংগ্রাম করতে হয়। সেগুলো হচ্ছে:
(ক) আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম: উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্যাঙ কীটপতঙ্গ খায়, অন্যদিকে সাপ ব্যাঙদের খায়। আবার ময়ূর সাপ এবং ব্যাঙ দুটোকেই খায়- এভাবে নিতান্ত জৈবিক কারণেই বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে খাদ্য-খাদক সম্পর্কের একটি নিষ্ঠুর জীবনসংগ্রাম গড়ে ওঠে।
(খ) অন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রাম: একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের খাদ্য ও বাসস্থান একই রকমের হওয়ায়, এদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এরা নিজেদের মধ্যেই বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা শুরু করে; উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে একটি দ্বীপে তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে গেলে খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সংগ্রাম শুরু করে। সবল প্রাণীগুলো দুর্বল প্রাণীদের প্রতিহত করে গ্রাসাচ্ছাদন করে। ফলে দুর্বল প্রাণীগুলো কিছুদিনের মধ্যেই অনাহারে মারা পড়ে। ..
(গ) পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম: বন্যা, খরা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বালিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত—এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ জীবের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে। সুতরাং জীবকে তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য প্রতিনিয়ত এসব প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়। যে প্রাণীগুলো এই পরিবেশে টিকে থাকতে পারে তারা বেঁচে থাকে অন্যরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে উত্তর ও মধ্য আমেরিকার কোয়েল পাখি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও তুষারপাতের ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
৪. প্রকরণ বা জীবদেহে পরিবর্তন
চার্লস ডারউইনের মতে, পৃথিবীতে দুটি জীব কখনোই অবিকল একই ধরনের হয় না। যত কমই হোক এদের মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য থাকে। জীব দুটির মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায়, তাকে প্রকরণ বা পরিবৃত্তি বলে। অস্তিত্বের জন্য জীবনসংগ্রামে অনুকূল প্রকরণ একটি জীবকে সাহায্য করে।
৫. যোগ্যতমের জয়
ডারউইনের মতে, যেসব প্রকরণ জীবের জীবনসংগ্রামের পক্ষে সহায়ক এবং পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনমূলক, তারাই কেবল বেঁচে থাকে; অন্যরা কালক্রমে পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়। মেরু অঞ্চলের ভাল্লুক বা বাঘ বা উদ্ভিদ গ্রীষ্মপ্রধান পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে না ।
৬. প্রাকৃতিক নির্বাচন
ডারউইন তত্ত্বের এই প্রতিপাদ্যটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘অনুকূল (বা অভিযোজনমূলক) প্রকরণ সমন্বিত জীবেরা অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে—এই প্রক্রিয়াকে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে।' অনুকূল প্রকরণ সমন্বিত জীবেরা প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত হয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যায় বেঁচে থাকে এবং অত্যধিক হারে বংশবিস্তার করে। অপরদিকে, প্রতিকূল প্রকরণসম্পন্ন জীবেরা প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে তারা অবলুপ্ত হয় (চিত্র ৪.২২)।ডারউইনের মতবাদ অনুসারে পরিবেশে যে জীবটি খাপ খাইয়ে নিবে, সে হবে যোগ্য এবং যোগ্য জীবটি পরিবেশে প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে বেঁচে থাকার জন্য বংশবৃদ্ধি করবে এবং টিকে থাকবে।
৭. নতুন প্রজাতির উৎপত্তি
যেসব প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে সুবিধাজনক প্রকরণ দেখা যায়, প্রকৃতি তাদের নির্বাচন করে এবং তাদের লালন করে। সুবিধাজনক প্রকরণযুক্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদ পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে এবং অযোগ্যদের তুলনার বেশি হারে বংশবিস্তার করতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে এদের বংশধরদের মধ্যে প্রকরণগুলো সঞ্চারিত হয়। এই বংশধরদের মধ্যে আবার যাদের সুবিধাজনক প্রকরণ বেশি থাকে, প্রকৃতি আবার তাদের নির্বাচন করে। এভাবে যুগ-যুগান্তর ধরে নির্বাচিত করে করে প্রকৃতি প্রাণী ও উদ্ভিদের নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করে।বর্তমানে বংশগতিবিদ, কোষতত্ত্ববিদ ও শ্রেণিবিদগণ নতুন প্রজাতির উৎপত্তির বিষয়ে মেন্ডেলের বংশগতি মতবাদের এবং ডারউইনের বিবর্তন মতবাদের ভিত্তিতে বলেন, ধীর গতিতে তিনটি ভিন্ন উপায়ে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হতে পারে:
(ক) মূল প্রজাতির থেকে পৃথক হয়ে (isolation) যাওয়ার ফলে
(খ) সংকরায়ণের (hybridization) ফলে এবং
(গ) সংকরায়ণ প্রজাতিতে কোষ বিভাজনের সময় ঘটনাক্রমে কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যার বৃদ্ধির (Polyploidy) ফলে। এর ফলে নতুন জীবটির অভিযোজন ঘটবে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা একটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হবে।
চার্লস ডারউইনকে জৈব বিবর্তনের জনক বলা হলেও তার মতবাদের ওপর এখনো কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। তার মতবাদের যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তার উত্তরের খোঁজে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীকে নিয়ে একবার একটা জরিপ নেওয়া হয়েছিল, জরিপের বিষয়বস্তু ছিল পৃথিবীর নানা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ কোনটি। বিজ্ঞানীরা রায় দিয়ে বলেছিলেন, বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্ব হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব।
Read more